অদম্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি (নতুন সংস্করণ) - প্রবন্ধ | NCTB BOOK

অদম্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

ভূমিকা: বাংলাদেশের অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। যোগ্য নেতৃত্ব, যথাযথ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তৃতি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, শক্তিশালী বাজার পরিকল্পনা প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশ যেভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা নজিরবিহীন।

অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ: ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় উৎপাদন প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার ছিল ৫.৪ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার (প্রায় ৪৫,০০০ টাকা)। অথচ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এই হার ৮.১৩ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ১৯০৯ মার্কিন ডলার (প্রায় ১,৬১,০০০ হাজার টাকা)। শুধু মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে তা-ই নয়, বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। বাজেটের আকার রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নে কমছে পরনির্ভরতা। সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্যের হার নিম্নমুখী। বর্তমান সময়ে দারিদ্র্যের হার ১৪ শতাংশেরও কম। জিডিপির হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ; ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ৩৩তম; আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যে-কোনো সূচকের বিচারে বাংলাদেশের অগ্রগতি অভূতপূর্ব।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন: একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার দৃশ্যমান দিক হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও জীবনমানের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা যায়। গত এক দশকে বাংলাদেশের এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। বড়ো বড়ো প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অল্প দিনের মধ্যেই চালু হবে বাংলাদেশের জনমানুষের বহুকাঙ্ক্ষিত পদ্মাসেতু। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সফলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে একটি মাইলফলক। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশে ছোটো-বড়ো অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব অবকাঠামো যথাসময়ে সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো এগিয়ে যাবে। এছাড়া সড়ক নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন ভবন নির্মাণও বর্তমানে দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানিকে সামনে রেখে পৃথক পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশীয় সম্পদ ব্যবহার করে দেশে উৎপাদন ব্যবস্থা সচল হবে, রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন বাড়বে, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আরো গতিশীল করে তুলছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে 'ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার' স্থাপন করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি উপজেলাকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনা হয়েছে। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটির অধিক এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে। থ্রি-জি ও ফোর- জি প্রযুক্তির মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট-১ উৎক্ষেপণ বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতে যুগান্তকারী ঘটনা। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব সম্প্রচার উপগ্রহ। ২০১৮ সালের ১১ই মে যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি ও তথ্যের মাধ্যমে দেশের সম্প্রচার কার্যক্রম সমৃদ্ধ হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছে।

মানবসম্পদ উন্নয়ন: বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যার দেশ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসম্পদে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করছে। সর্বস্তরে শিক্ষাকার্যক্রম নিশ্চিত করার ফলে একটি কর্মক্ষম দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে উঠছে। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রভৃতির মাধ্যমে দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। দেশে ও দেশের বাইরে উভয় ক্ষেত্রে তাদের কর্মসংস্থানের অনেক ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। কৃষি শিল্প, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্পসহ প্রতিটি শিল্পখাতের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বেড়েছে। চাকরি নির্ভরতা কমেছে; উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিতে শিক্ষিত উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক দশকে শুধু তথ্য-প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষের। বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লাখের অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। তারা নিয়মিত তাদের কষ্টে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় মানবসম্পদ এভাবে সবচেয়ে বড়ো প্রভাবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

বৈদেশিক বাণিজ্য: বাংলাদশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির আকার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমন বিস্তৃত হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য। বৈদেশিক পণ্য রপ্তানি আয়ে অর্জিত হয়েছে মাইলফলক। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি হয়েছে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার, যা এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পণ্য-রপ্তানি আয়।

প্রতিবন্ধকতা: ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে প্রথমবারের মতো আটকে দেওয়ার চক্রান্ত হয়। এরপর বহু বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়ে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল ধীরগতির। গত এক দশকে তা অস্বাভাবিক গতি অর্জন করেছে। তবে দেশে জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এই অগ্রযাত্রাকে খানিকটা ব্যাহত করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় দুর্নীতিও একটা বাধা। এসব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আরো অপ্রতিহত হবে, অগ্রগতি টেকসই হবে এবং অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।

উপসংহার: বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা এখন পুরো বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত। এর নাম দেওয়া যেতে পারে: অদম্য বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশকে। বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন সোনার বাংলার স্বপ্ন, চেয়েছিলেন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, গড়তে চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ। বর্তমান সরকার সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। উন্নতির এই ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্জন করতে পারে উন্নত দেশের মর্যাদা।

Content added By
Promotion